বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ও আদর্শ গ্রাম অস্ট্রিয়ার হলস্ট্যাট (Hallstatt)

১৯৯৭ সালে হলস্ট্যাট গ্রাম এবং তার পার্শ্ববর্তী ডাকস্টাইন সালসকামারগুট অঞ্চলকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করেছে UNESCO
কবির আহমেদ, ভিয়েনা, অষ্ট্রিয়াঃ অস্ট্রিয়া মধ্য ইউরোপের আল্পস পর্বতমালার পাদদেশের এক অপূর্ব প্রাকৃতিক নৈসর্গিক দেশ।৮৩,৮৫৫ বর্গ কিলোমিটার এবং প্রায় ৮৯ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত মধ্য ইউরোপের এই দেশটি ইউরোপের অন্যতম একটি ছোট দেশ।
দেশটির ৬০ ভাগ এলাকা জুড়ে আছে ইউরোপের বিখ্যাত আল্পস পর্বতমালা। আর দেশটির দক্ষিণ দিক থেকে পূর্ব দিকে ৩৫০ কিলোমিটার পথে বয়ে গেছে ইউরোপের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী দানিউব নদী (Donau)।
অস্ট্রিয়া বিশ্বের অন্যতম একটি পর্যটন সমৃদ্ধ দেশ।সারা বছর পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে দেশটিতে।পর্যটকদের কেউ আসেন আল্পস পর্বতমালার সৌন্দর্য উপভোগ করতে,কেউ আবার আসেন আল্পস পর্বতমালার পাদদেশে স্কি বা শীতকালীন খেলাধূলা করতে। তাছাড়াও অনেকে আসেন ঐতিহাসিক শহর অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা দর্শন করতে বা সঙ্গীত সম্রাট মোছাটের শহর Salzburg দেখতে।
অস্ট্রিয়া একটি শীত প্রধান দেশ।শীতকালে প্রচুর তুষারপাতের ফলে অস্ট্রিয়াকে বরফের সাদা চাদরে মুড়ে দেয়।গ্রীষ্মের সময় বরফ গলে গেলে, অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য নিয়ে ইউরোপের সবচেয়ে পুরানো গ্রাম এবং বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর জনপদ হলস্ট্যাট (Hallstatt)। যেখানে সময় থেমে গেছে অতি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে মোহিত হয়ে।
হলস্ট্যাট গ্রামটি উত্তর অস্ট্রিয়ার সালসকামারগুট আপার অস্ট্রিয়ার (Oberösterreich) রাজ্যের গেমুন্ডেন জেলার একটি ছোট গ্রাম।গ্রামটি Hallstätter See এর দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে এবং Dachstein massif এর খাড়া ঢালের মধ্যে অবস্থিত।
অস্ট্রিয়া বাংলাদেশ কমিউনিটির বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আঞ্চলিক সংগঠন জুলাই ও আগস্ট মাসে গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে এখানে ছুটে আসেন পিকনিক করতে। রাজধানী ভিয়েনা থেকে এখানে আসতে বাসে সময় লাগে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার মত।অবশ্য বৈশ্বিক মহামারী করোনার জন্য গত দুই বছর যাবত এখানে পর্যটকদের আসা প্রায় বন্ধ রয়েছে।

হলস্ট্যাট সংস্কৃতি: অস্ট্রিয়ার ইতিহাস থেকে জানা যায়,১৮৪৬ সাল থেকে ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত এই এলাকায় খনন কার্য চালিয়েছিল সে সময়ের একদল প্রত্নতাত্ত্বিক।তাদের এই খননের পর আবিষ্কৃত হয়েছিল ইউরোপের এক অজানা সভ্যতা ও সংস্কৃতি।জানা গিয়েছিল আল্পস পর্বতমালার প্রত্যন্তে লুকিয়ে থাকা এই এলাকাটিতেই ব্রোঞ্জ যুগের সমাপ্তি ও লৌহ যুগের সূত্রপাত ঘটেছিল।তাই, ব্রোঞ্জ ও প্রাথমিক লৌহ যুগের সংস্কৃতির নাম হলস্ট্যাট সংস্কৃতি।মধ্য ইউরোপে বিস্তার করা এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ সভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশ হয়েছিল এই হলস্ট্যাট গ্রাম থেকেই।
অস্ট্রিয়ান ইতিহাসবিদরা জানিয়েছেন চাষের উপর ভিত্তি করে এই হলস্ট্যাট সভ্যতাটি গড়ে উঠলেও, ধাতু শিল্পে যথেষ্ট উন্নত ছিল এই এলাকাটি। ইউরোপের সেল্টিক এবং প্রোটো-সেল্টিক মানুষেরা এখানে বাস করতেন বলে জানিয়েছেন ইতিহাসবিদরা।দীর্ঘ এলাকা জুড়ে বাণিজ্য চালাতেন তারা। ভূমধ্যসাগরীয় সংস্কৃতির সাথে অর্থনৈতিকভাবে যোগাযোগ ছিল হলস্ট্যাট সংস্কৃতির মানুষদের। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, নব্বইয়ের দশকে এই অঞ্চলের নিকটেই আল্পস পর্বতমালার বরফের নীচে চাপা পড়ে থাকা প্রায় ৫,০০০ বছর আগের মৃত মানুষের মমি উদ্ধার করা হয়েছে।যার নাম দেওয়া হয়েছে Ötzi।
তাছাড়াও এই এলাকাটিতে আছে এক প্রাগৈতিহাসিক যুগের লবণের খনি। ইতিহাসবিদদের মতে, এই লবণের খনিটি বিশ্বের প্রথম লবণ খনি হিসাবে ইতিমধ্যেই স্বীকৃতি লাভ করেছে। তৎকালীন সময়ে লবণ ছিল একটি মূল্যবান সম্পদ। তাই সেই খনি থেকে লবণ সংগ্রহের অর্থনীতি,হাজার হাজার বছর আগে জন্ম দিয়েছিল এক জনপদের। আর সেই প্রসিদ্ধ জনপদের নাম ছিল হলস্ট্যাট (Hallstatt)। আর তার নামেই এখানকার সংস্কৃতির নাম।
অস্ট্রিয়ান প্রত্নতাত্ত্বিকরা এলাকাটির বিভিন্ন জায়গায় খনন করে ব্রোঞ্জ এবং লোহার তৈরি প্রচুর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার করেছেন।লবণের খনির পাশেই তারা আবিষ্কার করেছিলেন প্রায় ২,০০০ হাজার মানুষের সমাধি বা কবর। সমাধিগুলিকে সময়ের বিচারে দুইটি স্তরে ভাগ করেছেন বিশেষজ্ঞদের দল।
প্রথম স্তরটি খ্রীষ্টপূর্ব ১,০০০ থেকে ৮০০ শত সাল এবং দ্বিতীয় স্তরের সমাধিগুলি খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০ শত সাল থেকে ৪৫০ সাল জুড়ে বিস্তৃত ছিল।লবণ একটি প্রাকৃতিক সংরক্ষক হিসাবে স্বীকৃত।তাই কয়েক হাজার বছর কবরে শুয়ে থাকা খনি শ্রমিকদের দেহ এবং জামাকাপড় আবিস্কারের সময়ও নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
হ্রদের পাড় থেকে আঁকাবাঁকা গলি পথ উঠে গেছে পাহাড়ের উপর। রাস্তার দুই পাশে শত শত বছরের পুরাতন বাড়িঘর কিন্ত এতটাই সুন্দর অবস্থায় সাজিয়ে রাখা হয়, দেখে মনে হবে বাড়িগুলি সম্প্রতি তৈরি করা হয়েছে।আসলে সত্যিকার অর্থে শুধুমাত্র অর্থ থাকলেই আস্ত একটা পাহাড়ি গ্রামকে ছবির মত সাজিয়ে রাখা যায় না।এখানকার বাসিন্দাদের হাজার বছরের উন্নতমানের নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গিই হল হলস্ট্যাটের সৌন্দর্যের গোপন রহস্য। তাই, পর্যটকেরা পাহাড়ের যত উঁচুতে উঠে ততই রূপসী হয়ে উঠে হলস্ট্যাট গ্রামটি।
চীনে নকল হলস্ট্যাট গ্রাম বানিয়েছে চীন: পৃথিবীতে নকল করতে চীনাদের জুড়ি মেলা ভার।২০১২ সালে চীনের গোয়াংডং প্রদেশে অস্ট্রিয়ার হলস্ট্যাট গ্রামের অনুকরণে পৃথিবীতে আরেকটি হলস্ট্যাট গ্রাম তৈরি করেছে চীন।

চীনের নকল হলস্ট্যাট গ্রামটি বানিয়েছে মিনমেটালস নামে চীনের এক নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। নকল হলস্ট্যাট গ্রামটি তৈরি করতে খরচ হয়েছে ৯৪০ মিলিয়ন ডলার।অস্ট্রিয়ার হলস্ট্যাট গ্রামের নিখুঁত অনুকরণে বাড়ি ঘর,গির্জা ও রাস্তাঘাট এমনকী লেকের আশপাশ সব কিছুই ছবির মতো সাজিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছে চীন।
অস্ট্রিয়ার পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী বৈশ্বিক মহামারী করোনার পূর্বে প্রতি বছর প্রায় দশ লাখ লোক আসেন অস্ট্রিয়া সহ সমগ্র বিশ্ব থেকে এই আদর্শ, সুন্দর ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহনকারী হলস্ট্যাট গ্রাম দেখতে।
14,826 total views, 1 views today