“কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির কারণ”

মোঃ নুরুল আমিন, ইউরো সমাচার প্রতিবেদকঃ দেশে কিশোর অপরাধ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। সারা দেশে কিশোরদের অশুভ তৎপরতায় পরিস্থিতি এখন গভীর উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত উঠতি বয়সের কিশোরদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে মানুষ শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। কিশোরদের নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন। তারা আমাদের ভবিষ্যত। তাদের আলো থেকে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি আমাদের জন্য সত্যি দুঃখজনক। উজ্জ্বল ভবিষ্যত জীবন গড়ার ভিত্তি স্থাপনের উপযুক্ত সময় হচ্ছে কৈশোর কাল। এটি মানব জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। কেননা এ সময়টুকুতে মন খুব নরম, আবেগপ্রবণ ও সংবেদনশীল হয়ে থাকে। তাছাড়া উঠতি বয়সীদের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিক একটা ভাব জমে এবং নিজেকে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করার ইচ্ছে প্রবল হয়ে ওঠে। তাই এ সময় তারা ভাল দিকে বাঁক নিলে যেমন ভাল কিছু করতে পারে, তেমনি খারাপ দিকে বাঁক নিলে ভয়ংকর হয়ে ওঠে।
পরিবেশ পরিস্থিতি ও পরামর্শের ওপর কিশোরদের ভাল-মন্দ নির্ভর করে। সমাজে বিষ ফোঁড়ার মতো নগ্ন ও অশ্লীল ছায়া ছবি, ভিসিআর, পর্ণ ভিডিও, মাদক দ্রব্যের সহজলভ্যতা, ইন্টারনেটের অপব্যবহার, সঙ্গদোষ ও অপসংস্কৃতি প্রভৃতি কিশোরদের কুপ্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তোলার ফলে অসামাজিক কার্যকলাপ ও অপরাধ প্রবণতা অস্বাভাবিকহারে বেড়ে চলছে। অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ার কারণে কোমলমতি কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হচ্ছে। তাছাড়া পারিবারিক শাসনের অভাব, অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা, আদর্শহীনতা, নৈতিক ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি কারণে কিশোররা বিপথগামী হয়ে আলো থেকে অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
অন্যদিকে অপরাধীর অবাধ পদচারণা, আইনের শিথিলতা ও আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা ইত্যাদি কিশোর অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। অপরাধ সংস্কৃতির জোয়ারে সুস্থ সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বিপন্ন হয়ে পড়ছে মানুষের জীবন। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট অপরাধ করতে করতে কিশোররা বড় অপরাধী হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে তৈরি হয় গ্যাং গ্রুপ। সাধারণত অষ্টম, নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যায়নরত ছাত্র কিংবা পাড়া বা মহল্লার উঠতি বয়সের ছেলেরা একসঙ্গে চলতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে কিংবা অন্য কারও সঙ্গে পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝির জের ধরে সহিংস হয়ে ওঠে। এরা সংঘবদ্ধ হয়ে খুব গ্যাদারিং করে। এমনকি চুরি, ছিনতাই, অপহরণ, ধর্ষণ, ইভটিজিং, অস্ত্রবহন, মাদক সেবন ও বিক্রি ইত্যাদি অপরাধমূলক কাজে কিশোররা জড়িয়ে পড়ে। আর এসব কিশোরদের পেছনে মদদ দিচ্ছে এক শ্রেণির অসাধু, ক্ষমতাধর ও শক্তিশালী সন্ত্রাসী চক্র। যারা আন্ডার ওয়ার্ল্ডের বড় ভাই বা গডফাদার হিসেবে পরিচিত। নিজেরা পর্দার আড়ালে থেকে গ্যাং গ্রুপের সদস্যদের দিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করায়।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ছোট-বড় শহরে দেখা যায় অনেক গরীব কিশোর অযত্ন-অবহেলাকে সঙ্গে করে প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে ওঠে। বস্তি এলাকায় এ ধরনের চিত্র বেশি দেখা যায়। নির্যাতন, নিপীড়ন ও বঞ্চনা সহ্য করে এসব অবহেলিত কিশোররা এক সময় অপরাধ জগতের অন্ধকারের দিকে পা বাড়ায়। চুরি, ছিনতাই, নেশাদ্রব্য গ্রহণ করে ধীরে ধীরে নানা অসামাজিক কার্যকলাপে যুক্ত হতে থাকে। আবার গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য এলাকার অন্যান্য উঠতি বয়সীদের টার্গেট করে এবং গ্রুপে টানতে থাকে। এভাবে সমাজে কিশোর অপরাধ প্রবণতা ও অপরাধীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। কিশোররা খেলাধুলা ও সুস্থ বিনোদনের সুযোগ তেমন পায় না। সামাজিক সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত হওয়ার সুযোগ তাদের তেমন নেই। যার কারণে তারা বিভিন্ন প্রলোভনে পড়ে অপরাধ জগতের দিকে বাঁক নেয়। দেশে অপরাধ সংস্কৃতির সকল বাহনের অবলুপ্তি একান্ত প্রয়োজন। কিশোরদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষা, মূল্যবোধ, আদর্শ ও ইতিবাচক ধ্যান-ধারণা জাগিয়ে তুলতে হবে। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে এখনই লাগাম টেনে ধরতে হবে। কিশোরদের ওপর সতর্ক নজর রাখতে হবে। ওরা কখন কোথায় যায়? কী করে? কার সঙ্গে মিশে? এসব খোঁজ-খবর নিতে হবে। তাদের ভাল বই পড়া, বাগান করা, মানুষের কল্যাণে এগিয়ে যাওয়া প্রভৃতি ভাল কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে হবে। নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। খেলাধুলা ও সুস্থ বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। দেশের একটি কিশোরও যাতে বিপথগামী না হয, সেজন্য পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, কবি, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক, লালমোহন, ভোলা। nurulamin911@gmail.com, 01759648626.
2,014 total views, 1 views today