১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

নিউজ ডেস্ক থেকে কবির আহমেদঃ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর বিজয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর কয়েক শতাধিক নাগরিককে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে হত্যা করে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস বাংলাদেশে পালিত একটি বিশেষ দিবস। প্রতিবছর বাংলাদেশে ১৪ ডিসেম্বর দিনটিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর কয়েক শতাধিক নাগরিককে ঢাকার রায়ের বাজারের বধ্যভূমি সহ আরও কয়েক জায়গায় গুলি করে হত্যা করে। এই সমস্ত শহীদদের মধ্যে রয়েছেন দেশের বিভিন্ন ক্যাটাগরির বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, লেখক,সমাজ সেবক সহ অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্য।
হানাদার,স্বৈরাচারী ও বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জঘন্য এই মানবতাবিরোধী হত্যাকাণ্ডে আমাদের বাংলাদেশের রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর সদস্যরা তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আসলে ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের রাত থেকেই দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করা শুরু করে। তবে ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডটি ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয়ের একটি প্রতিশোধ।তারা যখন দেখল যে,তাদের পরাজয় নিশ্চিত,তাই তারা পরিকল্পনা করল যে,দেশের এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করলে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও তারা আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না।
দেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় বলতে আমরা বলতে পারি যে, প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী যারা দেশে দৈহিক শ্রমের বদলে মানসিক শ্রম বা বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম দেন তারাই বুদ্ধিজীবী। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে বুদ্ধিজীবীদের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা হলো: বুদ্ধিজীবী অর্থ লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবী।
ইতিহাসবিদরা জানান,১৯৭১ এর ডিসেম্বর মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন বুঝতে শুরু করে যে তাদের পক্ষে যুদ্ধে জেতা সম্ভব না, তখন তারা নবগঠিত দেশকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে দুর্বল এবং পঙ্গু করে দেয়ার জন্য পরিকল্পনা করতে থাকে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সহায়তায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিজ নিজ গৃহ হতে তুলে এনে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে। এই পরিকল্পিত গণহত্যাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত।

বন্দী অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত লাশ রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। অনেকের লাশ শনাক্তও করা যায়নি, পাওয়াও যায়নি বহু লাশ। ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বরের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পালিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বুদ্ধিজীবী হত্যার স্মরণে বাংলাদেশের ঢাকায় বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ডাকবিভাগ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে একটি স্মারক ডাকটিকিটের সিরিজ বের করেছে।
বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঠিক দুই দিন পর ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বাধীন বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে(সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভারতের তৎকালীন পূর্বাঞ্চলীয় সেনা প্রধান জেনারেল অরোরার নেতৃত্বাধীন মিত্র বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। ফলে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
যথাযোগ্য মর্যাদায় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস-২০২১ পালনের লক্ষ্যে জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ উপলক্ষে পৃথক বাণী প্রদান করবেন।
দিবসটি উপলক্ষে সকাল ৭ টা ৫ মিনিটে মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যরা এবং যুদ্ধাহত ও উপস্থিত বীর মুক্তিযোদ্ধারা সকাল ৭টা ২২ মিনিটে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে এবং সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে পুস্পস্তবকবক অর্পণ করবেন। সকাল ৮ টা ৩০ মিনিটে থেকে সর্বস্তরের জনগণ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। দেশের সকল জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অন্য বেসরকারি টিভি চ্যানেল দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করবে।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে, বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী সংগঠনের কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ। সকাল ৮টায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ নিবেদন। সকাল ৮ টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে এবং সকাল ৯ টায় রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ।
এদিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিও পৃথক কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। রোববার ১২ ডিসেম্বর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিবৃতিতে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
কর্মসূচিতে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে ১৪ ডিসেম্বর দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশের দলীয় কার্যালয়গুলো কালো পতাকা উত্তোলন ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ করা হবে জানানো হয়। এছাড়া সকাল ৯টায় মিরপুরস্থ শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভে পুস্পার্ঘ অর্পণ ও দিবসটি উপলক্ষে সোমবার দুপুর ২টায় রমনাস্থ ইন্সটিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স-বাংলাদেশ মিলনায়তনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
14,771 total views, 1 views today