মাহে রমজানের গুরুত্ব

ভিয়ানা থেকে কবির আহমেদঃ ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম হলো সিয়াম (রোজা)। নামাজের পরেই মুসলমানদের প্রতি আল্লাহতায়ালা যে ইবাদত ফরজ করেছেন তা হচ্ছে মাহে রমজানের রোজা। দ্বিতীয় হিজরি সালে উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হয়। তবে এই রোজা অন্যান্য জাতির ওপরও ফরজ ছিল।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘হে ইমানদার নর-নারীগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেওয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকি (আল্লাহ ভীরু) হয়ে চলতে পার।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৮৩)। ‘রামাদান’ শব্দটি আরবি ‘রামদ’ ধাতু থেকে উদ্ভূত। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে দহন, প্রজ্বলন, জ্বালানো বা পুড়িয়ে ভস্ম করে ফেলা।
রমজান মাসে সিয়াম সাধনা তথা রোজা পালনের মাধ্যমে ধর্মপ্রাণ মানুষ নিজের সমুদয় জাগতিক কামনা-বাসনা পরিহার করে আত্মসংযম ও সুশৃঙ্খল শান্তিময় জীবনযাপন করে এবং ষড়রিপুকে দমন করে আল্লাহর একনিষ্ঠ অনুগত বান্দা হওয়ার সামর্থ্য অর্জন করে। মাহে রমজান মানুষের অভ্যন্তরীণ যাবতীয় অহংকার, কুপ্রবৃত্তি, নফসের দাসত্ব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় বলে এ মহিমান্বিত মাসের আরবি নাম ‘রামাদান’। ইসলামের অন্যান্য বহু আদেশ-নির্দেশের মতো রোজাও ফরজ হয়েছে।
আল্লাহতায়ালা কেবল মাহে রমজানের রোজা নির্দিষ্ট ও এতেই সীমাবদ্ধ করে দেননি, বরং শরিয়তসম্মত কোনো অনিবার্য কারণবশত কেউ এ রমজান মাসে রোজা পালন করতে না পারলেও এরপর অন্য যে কোনো সময় রোজার কাজা আদায় করার পথও উন্মুক্ত রেখেছেন। পবিত্র কোরআন কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘রমজান মাস, এতে মানুষের দিশারি এবং সৎ পথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে এবং কেউ অসুস্থ থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এর সংখ্যা পূরণ করতে হবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য কষ্টকর তা চান না, এ জন্য যে তোমরা যেন রোজার সংখ্যা পূর্ণ করবে এবং তোমাদের সৎ পথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মহিমা বর্ণনা করবে, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৮৫)।
মাহে রমজানের অন্যতম ফজিলত হলো, এ মাস পবিত্র কোরআন নাজিলের মাস। মূলত এ কারণেই এ মাসের এত বেশি মর্যাদা। এ মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রিয় নবী (দ.) বলেন, ‘রমজান মাস এলে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয়, জাহান্নামের দ্বারসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলিত করা হয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৮০০)। রোজার প্রতিদান সম্পর্কে হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, ‘বনি আদমের সব আমল তার জন্য, অবশ্য রোজার কথা আলাদা, কেননা রোজা আমার জন্য এবং আমিই এর পুরস্কার প্রতিদান দেব’। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৮০৫)।
রোজা রাখার মাধ্যমে গুনাহের কাফফারা হয় এবং মাগফিরাত লাভ হয়। রসুল (দ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রামাদান মাসে রোজা রাখবে, তার আগের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে’। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৯১০)। শুধু তাই নয়, রোজা রাখার মাধ্যমে জান্নাত লাভ হয়। রসুল (দ.) বলেন, ‘জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে যাকে বলা হয় ‘রাইয়ান’। কেয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে রোজাদাররা প্রবেশ করবে। অন্য কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না’। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৭৯৭)।
সিয়াম রোজাদারের জন্য কেয়ামতের দিন সুপারিশ করবেন বলে ঘোষণা করেছেন রসুল (দ.)। রসুলুল্লাহ (দ.) ইরশাদ করেন, ‘কেয়ামতের দিন রোজা এবং কোরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, ‘হে রব! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও প্রবৃত্তির কামনা হতে বাধা দিয়েছি; সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন।’ কোরআন বলবে, ‘আমি তাকে রাতের বেলায় ঘুমাতে দিইনি; সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। ফলে এ দুয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে’। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং ৬৬২৬)। তাকওয়া অর্জনের এ মোবারক মাসে মুমিনদের ওপর অর্পিত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, সৃষ্টি হয়েছে পুণ্য অর্জনের বিশাল সুযোগ এবং প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে মহান চরিত্র অর্জনের সুন্দর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। এ অর্পিত দায়িত্ব পালন এবং সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আজ সারা বিশ্বের মুসলিমদের উচিত চারিত্রিক অধঃপতন থেকে নিজেদের রক্ষা করা, চেতনাকে জাগ্রত করা এবং সব ধরনের শয়তানি শক্তির বলয় থেকে মুক্ত হয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞাকে সুদৃঢ় করা। মাহে রমজানে রোজার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা মানুষের কুপ্রবৃত্তিকে দমন করেন। রিপুর তাড়না থেকে তাকে মুক্ত করে তার ভিতর তাকওয়া-খোদাভীতি ও আল্লাহপ্রেম জাগ্রত করতে চান। এ সত্য-সুন্দরের পথ তাকে সাফল্য ও মুক্তির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে। শুধু পানাহার পাপাচার বর্জনই নয়, রোজা পালনের মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের মহামারির এ সময়ে আমরা আল্লাহতায়ালার প্রিয় বান্দা রসুল (দ.)-এর প্রিয় উম্মত হয়ে জান্নাতের মেহমান হতে পারি, আল্লাহতায়ালা আমাদের সে তৌফিক দান করুন, আমিন ।
4,136 total views, 1 views today