চলন্ত লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক জানমালের ক্ষয়ক্ষতি,দায়ভার কার ?

সুরাহা না করলেবরগুনাগামী লঞ্চে  অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নয়। এটা অব্যবস্থাপনার এক চেইন অব ইভেন্ট।এগুলোর এ রকম ঘটনা ভবিষ্যতে আরো ঘটতে পারে।

 কবির আহমেদ, ভিয়েনা, অষ্ট্রিয়াঃ গণপরিবহন সহ নানান যানবাহনে দুর্ঘটনা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কমবেশী ঘটে থাকে। পাশ্চাত্য আধুনিক বিশ্বেও দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।তবে আমাদের বাংলাদেশে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে তার পুরোটাই অসাবধানতা এবং নিয়ম না মানার কারণে ঘটে। আর প্রতিবারই এর শিকার হয় সাধারণ মানুষ। এবারও তার ব্যাতিক্রম ঘটে নি।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ঝালকাঠি জেলার সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বরগুনাগামী এম ভি “অভিযান-১০” লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে এই পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৪১ জন এবং শতাধিক মানুষ আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন।তাছাড়াও এখনও কয়েক ডজন মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের ভাগ্যে কি আছে এখনও কিছুই বলা যাচ্ছে না।প্রত্যক্ষদর্শী এবং বেঁচে যাওয়া অনেক যাত্রীই বলেছেন বহুতল বিশিষ্ট লঞ্চের তিনতলা এবং দোতালা থেকেও মানুষ আগুন থেকে বাঁচার জন্য সুগন্ধা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন।ফায়ার ব্রিগেড সহ ঝালকাঠি প্রশাসন সুগন্ধা নদীতে তাদের অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছেন।তাই এই দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

দুর্ঘটনার পর প্রথম প্রাথমিক তদন্তে জানা গেল, লঞ্চটির ফিটনেস রয়েছে ২০২২ পর্যন্ত।কিন্তু বিভিন্ন জাতীয় সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী লঞ্চটিতে সেইফটি লেভেল বা অগ্নিকাণ্ড অথবা অন্যান্য জীবন রক্ষাকারী পূর্ব ব্যবস্থা ছিল শূন্যের ঘরে! লঞ্চটি যাত্রীদের জন্য কোনভাবেই নিরাপদ ছিল না।

আরও জানান গেছে, লঞ্চের নিচতলার ইঞ্জিন রুমে রাখা ছিল প্রায় পনেরো বিশ ব্যারেল ডিজেল।যেখানে ইঞ্জিন চলে সেই একই ঘরে কিভাবে এতো পরিমাণ অত্যন্ত দাহ্য ডিজেল রাখা হয়? এভাবেই কি অন্য সব লঞ্চে ডিজেল রাখা হচ্ছে? তারপর ইঞ্জিন রুমের পাশেই ছিল কিচেন, যেখানে ব্যবহার করা হচ্ছিল সিলিন্ডার গ্যাস। ওই গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে নিশ্চিত হয়েছেন ঝালকাঠির ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। এতবড় একটি লঞ্চের পাশাপাশি দুইটি রুমে ইঞ্জিন, ২০ ব্যারেল ডিজেল আর অনিরাপদ গ্যাস সিলিন্ডার, আগুন তো লাগবেই।

এখন কথা হচ্ছে, সেইফটি অফিসার কিভাবে এই ধরনের অবকাঠামোগত ব্যবস্থার ছাড়পত্র দেয়? পৃথিবীর কোনো দেশেই এই ধরনের ব্যবস্থাকে সেইফ বা নিরাপদ বলবে না। এর ফলে কোনো ছাড়পত্রও দিবে না। তেলের ব্যারেলগুলো খুব সহজেই রাখা যেত কিচেন থেকে দূরে একটি ফায়ারপ্রুফ কক্ষে।

খবরে জানা গেছে, আগুন নিচতলা থেকে ছড়িয়ে পড়ে ২য় তলায়। সেখানকার চায়ের দোকানে ছিল আরেকটি গ্যাস সিলিন্ডার। সেটারও বিস্ফোরণ ঘটে এবং ২য় তলায়ও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আর এই আগুন নিয়ে লঞ্চটি চলতে থাকে।কি বিভৎস এক অবস্থা! লঞ্চে কি আদৌ কোনো ফায়ার এলার্ম ছিল? ইঞ্জিন রুমে থাকার কথা বেশ কয়েকটি অগ্নিনির্বাপক গ্যাস সিলিন্ডার। সেগুলোর কি কোন ব্যবহার হয়েছে? লঞ্চের ইঞ্জিন রুমের দায়িত্বে থাকা লোকটির কি যথাযথ অগ্নিনির্বাপনের ট্রেইনিং দেওয়া আছে?

আমাদের ধারণা এগুলোর কিছুই ছিল না লঞ্চটিতে।দেশেল অন্যান্য লঞ্চেও হয়তো একই অবস্থা।তারপরও দেখা যাবে সব লঞ্চেরই হয়তো ফিটনেস রয়েছে! এ ধরনের ফিটনেসের আসলে কোন মূল্য নেই।যেখানে সেইফটি কনসার্ন রয়েছে সেখানে কোনোভাবেই বলা যাবে না যে, যানটি ফিট। আমরা সবাই জানি,পয়সার বিনিময়ে অনেক অসুধোপায়ী কর্মকর্তা এই ধরনের কাজ করে থাকেন।ফলে এতোবড় দুর্ঘটনার মত ঘটনাও ঘটে থাকে,যা পরবর্তীতে জাতীয় ঘটনায় রুপান্তরিত হয়ে থাকে।

গত ২৩ ডিসেম্বর লঞ্চে যে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো তা কোনোভাবেই নিছক দুর্ঘটনা নয়।এটা অব্যবস্থাপনার এক চেইন অব ইভেন্ট।এগুলোর সুরাহা না করলে এ রকম ঘটনা ভবিষ্যতে আরো ঘটবে।মাঝখান থেকে জীবন যাবে অসংখ্য নিরীহ মানুষের।

লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 14,612 total views,  1 views today