মানুষের জীবনে হিংসা একটি ভয়ানক সংক্রামক ব্যাধি

কবির আহমেদ,ভিয়েনা, অষ্ট্রিয়াঃ মানুষের হীন মন-মানসিকতা, ঈর্ষাপরায়ণতা, সম্পদের মোহ, পদমর্যাদার লোভ-লালসা থেকে হিংসা-বিদ্বেষের উৎপত্তি ও বিকাশ হয় বলে জানিয়েছেন মনীষিরা।
ইসলাম ধর্মে তাই হিংসার ব্যাপারে ব্যাপক সতর্কতা দেয়া হয়েছে।হিংসা-বিদ্বেষ মুমিনের নেক আমল ও প্রতিদানকে এবং নেক আমলের বা ভালো কাজের প্রতি তার আগ্রহী মনকে নীরবে ধ্বংস করে দেয়।
হিংসা-বিদ্বেষ তুষের আগুনের মতোই ভিতরে ভিতরে মানব চরিত্রের সকল ভালো গুণ গুলিকে জালিয়ে ভস্ম করে দেয়। হিংসা নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক কথা প্রচলিত আছে। তার কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হল,
হিংসা নিয়ে উক্তিঃ
১. হিংসা পতনের মূল।
২. লোভ, হিংসা, অহংহার মানুষের ধংসের মূল।
৩. হিংসা মানুষের মাঝে ভেদাভেদ তৈরি করে দেয়।
৪. হিংসা ধীরে ধীরে অন্তরে কলুষতা তৈরি করে দেয়।
৫. হিংসা পরায়ন ব্যক্তি কখনো শান্তি পায় না।
৬. হিংসা মানুষের ভাল গুণ সমূহ ঢেকে দেয়।
৭. ইসলাম ধর্মের মতে,এক বিন্দু পরিমাণ হিংসা নিয়ে কোন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা।
৮. হিংসা সমাজের উন্নতির অন্তরায়।
৯. হিংসা পরায়ণ ব্যক্তির শান্তি খুঁজে পায় না।
১০. হিংসা অহংকারের সমতুল্য।আর অহংকার পতনের মূল।
ইসলাম অন্যের প্রতি হিংসা করা বা প্রতিহিংসাপরায়ণ হওয়াকে সম্পূর্ণরূপে হারাম বা নিষিদ্ধ করেছে।মানুষের মধ্যে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষের ফলে সামাজিক শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়।তাই মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সতর্ক করে বলেছেন, “আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন, সেজন্য কি তারা তাদের ঈর্ষা করে?’[সূরা নিসা, আয়াত: ৫৪]
মানুষ হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, শঠতা-কপটতা, অশান্তি, হানাহানি ইত্যাদি সামাজিক অনাচারের পথ পরিহার করে পারস্পরিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবে এবং ইসলামি জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ হবে, এটিই দিন-ইসলামের মূলকথা।
হিংসা ও ঈর্ষা মানুষকে কত অধঃপতনে নিয়ে যায়, তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ঈর্ষা ও হিংসা প্রায় একই রকম আবেগ, তবে হিংসাকে বলা হয় ঈর্ষার চরম বহিঃপ্রকাশ। ঈর্ষাকাতরতা হিংসার পর্যায়ে চলে গেলে আক্রোশবশত মানুষ হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটিয়ে ফেলতে পারে।
হিংসুক ব্যক্তি অন্যের ভালো কিছু সহ্য করতে পারে না, কাউকে কোনো উন্নতি বা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দেখলে অন্তরে জ্বালা অনুভব করে। এহেন অশোভন আচরণ সম্পূর্ণ ইসলাম পরিপন্থী। হিংসুক ব্যক্তি যখন হিংসাত্মক কাজে লিপ্ত থাকে, তখন তাকে পরিত্যাগ করা অবশ্য কর্তব্য।
এই জন্য হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকার লক্ষ্যে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনার জন্য পবিত্র কোরআনে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে,”আর হিংসুকের অনিষ্ট থেকে পানাহ চাই, যখন সে হিংসা করে।” [সূরা ফালাক, আয়াত: ৫]
দৈনন্দিন জীবনে হিংসার বহুবিধ কারণ যেমন পারস্পরিক ঈর্ষাপরায়ণতা, পরশ্রীকাতরতা, শত্রুতা, দাম্ভিকতা, নিজের অসৎ উদ্দেশ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা, নেতৃত্ব বা ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা, অনুগত লোকদের যোগ্যতা সম্পন্ন হয়ে যাওয়া এবং কোনো সুযোগ-সুবিধা হাসিল হওয়া, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নীচুতা বা কার্পণ্য প্রভৃতি বিদ্যমান।
নানা কারণে এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির প্রতি হিংসা প্রকাশ করে থাকে। প্রিয নবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, “তোমরা অন্যের প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করা থেকে বেঁচে থাকবে, কেননা এরূপ ধারণা জঘন্যতম মিথ্যা। আর কারো দোষ অনুসন্ধান করবে না, কারো গোপনীয় বিষয় অন্বেষণ করবে না, একে অন্যকে ধোঁকা দেবে না, পরস্পর হিংসা করবে না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করবে না, পরস্পর বিরুদ্ধাচরণ করবে না, বরং তোমরা সবাই এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে থাকবে।’ [সহীহ বুখারি ও মুসলিম শরীফ]
মানুষ হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকুক এবং মানব সমাজে সামাজিক শান্তি-সম্প্রীতি বজায় থাকুক এটাই মহান আল্লাহতায়ালার একান্ত অভিপ্রায়। একজন প্রকৃত ইমানদার ব্যক্তি কখনো হিংসার বশবর্তী হতে পারেন না। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মোমিন বান্দার পেটে আল্লাহর রাস্তার ধুলা এবং জাহান্নামের আগুন একত্রে জমা হতে পারে না। একইভাবে হিংসা এবং ঈমানও কোনো বান্দার মাঝে একত্রে থাকতে পারে না’- (নাসাই)।
এ ছাড়াও হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে আরো একটি হাদিসে বর্ণিত রাসুল (স.) বলেছেন, ‘কোনো বান্দার হৃদয়ে ঈমান ও হিংসা একত্রে থাকতে পারে না’- (সুনানে নাসাই: ৩১০৯)।
মানুষের বদভ্যাস সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, তিনটি বদভ্যাস আছে, যা থেকে কেউ মুক্ত নয়। ১. কু-ধারণা ২. হিংসা ৩. অশুভ ফলাফলে বিশ্বাস। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, এসব থেকে মুক্ত থাকার উপায় কী? তিনি বললেন, ‘কারো প্রতি কু-ধারণা এলে তা বিশ্বাস না করা, হিংসার উদ্রেক হলে প্রকাশ না করা আর কাজ থেকে ফিরে না আসা’- (মাজমাউজ জাওয়াইদ)।
হিংসা এমন একটি খারাপ অভ্যাস যা মানুষের নৈতিক চরিত্র তো ধ্বংস করেই তার সঙ্গে ধর্মীয় অনুভূতিগুলোকেও ধ্বংস করে দেয়। তাইতো নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাক। কারণ হিংসা দীন ধ্বংস করে দেয়’- (তিরমিজি)। এ ছাড়াও হজরত জুবায়ের ইবনুল আওয়াম (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে পিপীলিকার মতো প্রবেশ করবে বিগত উম্মতদের রোগ। আর তা হলো হিংসা ও বিদ্বেষ; যা হলো মু-নকারী। আমি বলি না যে চুল মু-ন করবে, বরং তা দীনকে মু-ন করে ফেলবে’- (তিরমিজি: ৫০৩৯)।
হিংসুকরা আল্লাহর নিয়ামতের শত্রু, গোটা মোমিনের শত্রু। তাইতো রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহর নিয়ামতের শত্রু আছে।’ সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহর নিয়ামতের শত্রু কারা? রাসুল (সা.) বললেন, ‘হিংসুকরা। হিংসুক তো এজন্যই হিংসা করে- আল্লাহ কেন তার বান্দাকে অনুগ্রহ করেছেন’- (দাওয়াউল হাসাদ)। এ ছাড়াও ইমাম বাকির (রহ.) বলেন, ‘হিংসা ইমানকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেয়’- (আল কাফি, খ- ২, পৃষ্ঠা-৩০৬, হাদিস নং-১)। হিংসার পরিণাম সম্পর্কে ইমাম জাফর সাদিক (রহ.) বলেন, ‘একে অপরের সঙ্গে হিংসা করা থেকে বিরত থাকো, কেননা হিংসা হলো কুফরের ভিত্তিস্বরূপ’- (আল কাফি, খ- ৮, পৃষ্ঠা-৮, হাদিস নং-১)। হিংসুক বান্দাহদের আল্লাহতায়ালা ক্ষমা করবেন না আর ইহকাল ও পরকালে তাদের পরিণতি ভয়াবহ। তাইতো নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘অর্ধ শাবানের রাতে (অর্থাৎ শবেবরাতে) আল্লাহতায়ালা তার সব সৃষ্টিকেই ক্ষমা করে দেন। তবে তিনি মুশরিক ও হিংসা-বিদ্বেষপোষণকারীকে ক্ষমা করেন না’- (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৩৯০)।
পরিশেষে বলা যায় যে, হিংসা মানুষের একটি আত্মিক রোগ। যা মরণ-ব্যাধির চেয়েও ভয়ংকর। এই হিংসাই মানব আত্মাকে দূষিত ও কলুষিত করে এবং সব নেক আমলকে নষ্ট করে দেয়। অতএব সব মানব সন্তানেরই হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকা অবশ্য কর্তব্য।
কবির আহমেদ, লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
14,623 total views, 1 views today