দূর প্রবাসের যাত্রী
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলেন অলিউর রহমান। প্রতিদিন কাজে যাওয়ার জন্য উঠতে হয়।আর আজ ঘুম থেকে উঠলেন মনের আনন্দে। মোবাইল ফোনটি হাতে নেওয়ার পরপরই দেখেন বেশ কয়েকটি কল এসেছে। ডিসপ্লেতে কল দেখেই বুঝতে আর বাকি রইলনা কে ফোন করেছে।
মুখে টুথ ব্রাশ রেখেই ফোন দেন দেশে থাকা মাকে। অপর প্রান্ত থেকে অলি কিতা কররেরে ফুত। মায়ের এমন আবেগতাড়িত কথা শুনেই চোখে জল চলে আসে অলির।
চোখের জল মুছতে মুছতে মাকেই উল্টো প্রশ্ন করেন তুমি কিতা কররায়। গরু কোরবানী দিছনি, মাংস খাইছনি। আমরার হকলে গরুর মাংস পাইছননি। অপর প্রান্তে থাকা মা আবারো বলে উঠলেন- বাবারে তুমি কিতা খররায়।
তুমি কিচ্ছু খাইছনি। মায়ের এমন আবেগতাড়িত কথা আবারো তীরের মত বিধে অলির হৃদয়ে। মাকে আবারও ঈদের সালাম জানিয়ে ভালমন্দ জানার চেষ্ঠা করেন। কিন্তু মায়ের একটাই প্রশ্ন বাবা তুমি খাইছনি।
মুখে ব্রাশ তার ওপর ঘুমের ঘোর। সব মিলিয়ে ঈদের এই দিনে যেখানে খুশী হওয়ার কথা সেখানে মায়ের কথা শুনে চোখের জল ফেলতে ফেলতে মাকে জানালেন তিনি ঘুম থেকে উঠেছেন। এখন ব্রাশ করছেন। ফ্রেশ হয়েই ঈদের নামাজ পড়তে যাবেন। শুধু অলি নয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসীদের ঈদ কাটাতে হয় এভাবেই পরিবার পরিজন ছাড়া। তারা বিদেশে ঈদ করলও মন পড়ে থাকে দেশে।
পবিত্র ঈদুল আযহা উদযাপিত হয়েছে গত ১২ আগষ্ট। কিন্তু ঈদের মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর কেন এটি লিখছি। সেটি অনেকের কাছে প্রশ্ন হিসাবে দেখা দিতে পারে।
তার একটাই কারন নিজে একজন প্রবাসী। দেশেও আমার রয়েছে স্বজন। আমারও ইচ্ছে হয় দেশের মাটিতে পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে ঈদ করতে। কিন্তু পারছি কই ? আর এই লেখাটি লিখছি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসীদের কথা চিন্তা করে।
এখন আসি মূল কথায়- মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব নিয়ে সারা বছর মুখিয়ে থাকেন পরবাসে স্বজনহীন প্রবাসীরা। এই লেখাটি লেখার একটাই কারণ প্রবাসীদের একত্রীকরণ। কাঙ্খিত এ দুটি দিন নিয়ে অনেক প্রত্যাশা আকাঙ্খা অনেক। শুধুমাত্র নামাজের পর একটু কোলাকুলি, করমর্দন ছাড়া আর কিছুই করা হয়ে ওঠেনা।
সাদামাটা আনন্দহীন কেটে যায় প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসবের দিনগুলো। প্রবাসের এই দুটি দিনকে আরো স্মরণীয় এবং বরণীয় এবং আকর্ষণীয় করতে কিভাবে এগোনো যায় একারনেই অসময়ে এই লেখাটি। বিবেকতাড়িত হয়ে ভাবনা গুলো লিখতে বাধ্য হয়েছি । তবুও আশা নিয়ে প্রবাসীরা বেঁচে থাকেন, আবারও নতুন করে স্বপ্ন দেখেন নতুন বছরের নতুন দুটি উৎসব পালনের।
শুধু স্পেনের মাদ্রিদ নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসীদের একই অবস্থা। মুসলমানদের বৃহৎ এ দুটি উৎসব নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশী কমিউনিটির কোন দায় পরিলক্ষিত হচ্ছেনা।
অথচ ইসলাম এ দুটি দিনে আনন্দঘন পরিবেশে কাটানোর উৎসাহ দিয়েছে। কিন্তু এই দুটি দিন শুধুমাত্র কোলাকুলি আর দেশে স্বজনদের ফোনে কথা বলা ছাড়া তেমন কিছুই হয়ে ওঠেনা প্রবাসীদের।
দুটি ঈদে ৭ থেকে ৮ হাজার মানুষের সমাবেশ হয় এই দুটি ঈদে। অথচ উৎসব পালনে কোন বরাদ্দ মিলেনা। মুসলমানদের এ দুটি উৎসব পালনে বরাদ্ধ থাকলে প্রবাসে থাকা প্রবাসীরা সকলকে নিয়ে আরো সুন্দরভাবে উৎসব পালন করতে পারতেন।
এক পরিসংখানে দেখা যায় কমিউনিটির লোকজনের কাছে মাদ্রিদ একটি অন্যতম পরিচিত শহর। এখানে রয়েছে ৩০ টির মত সংগঠন। যাদের বার্ষিক বাজেট থাকে ৭ থেকে ১৫ হাজার ইউরো। আর সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ এসোসিয়েশন তার নির্বাচনে খরচ হয়েছে প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার ইউরো। শুধুমাত্র নির্বাচনী পরিচালনা খরচ হয়েছে ২৭ হাজার ইউরো।
এত খরচের পরেও দুটি ঈদ উৎসব নিয়ে কমিউনিটিতে তেমন কোন উদ্যোগ নেই। আর এটি না থাকায় প্রবাসে থাকা পরিবারের সন্তানগুলোর মধ্যে উৎসবের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। পুরুষ ছেলেরা বাবার হাত ধরে নামাজে যায় আর মেয়েদের অধিকাংশ ঘরে বসেই ঈদ পালন করে। জাকজমকপূর্ণভাবে ঈদ অনুষ্ঠান করা গেলে পরিবারের লোকদের মধ্যে একটি মেলবন্ধন তৈরী হত। কমিউনিটির একে অপরকে ভাল করে জানতে পারত।
সবচেয়ে সুখের কথা ,ইউরোপের একমাত্র শহর মাদ্রিদ, যেখানে বাঙ্গালী কমিউনিটিতে এখনো কোন্দল মহামারী আকারে দেখা দেয়নি। এখন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন এক ও অভিন্ন সংগঠন। এখনো ঈদের নামাজ হয় , সম্মিলিতভাবে সবাই একই মাঠে নামাজ আদায় করেন।
এখন কথা হল দুই ঈদের অনেক সুযোগ আছে। এখন সেই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজন স্বদিচ্ছার। দুই ঈদে উৎসবের ছাপ পড়েনা বাঙ্গালী পাড়াখ্যাত পুরো লাভাপিবেচে। এমনকি সেখানে সাজ সজ্জা হয়না,উৎসব মুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয় না । উৎসবের আমেজ নিয়ে একদিনের জন্য হলেও বাংলাদেশী মালিকানাধীন হোটেল রেস্তোরাঁগুলোতে ঈদের সেমাই ফিন্নি আর রকমারি খাবার তৈরী হয়না। অথচ বাঙ্গালী নানা পদের খাবার বানিয়ে রেস্তোরাগুলোতে বিক্রি করা হলে আমাদের ভবিষ্যত কর্ণধাররা জানতে পারত এভাবেই ঈদে দেশে খাবার তৈরী হয়।
ঈদে নানা ধরনের পিঠা হয় আমাদের দেশে। পাটি সাপটা, পুলি পিঠা, সন্দেষ, বাপা পিঠা, তাল পিঠা, খেজুরের রসের পিঠা, চিতই পিঠা, চই পিঠা, মেড়া পুঠা, নারকেলের পিঠা, চুঙ্গা পিঠা, চালের গুড়ির রুটিসহ নান স্বাদের নানা পিঠা। অথচ আমাদের আগামী প্রজন্ম এসব পিঠা প্রসঙ্গে কিছুই জানেনা। তারা চেনে ফাস্ট ফুড।
আমাদের অনেক ঐতিহ্য আছে। যে অনুষ্ঠান করে আমরা বাঙালি অধ্যুষিত লাভপিএসসহ বিদেশীদের কাছে আমাদেরকে তুলে ধরতে পারতাম, একটু ভিন্নভাবে, ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন রূপে। নতুন প্রজন্মের কাছে দাগ কেটে যেত এই অনুষ্ঠান ঘিরে। সুন্দর ,আলোকিত কমিউনিটি বিনির্মাণে সহযোগিতা প্রয়োজন সকলের। এগিয়ে আসি, এগিয়ে যাই এই প্রত্যাশা।
লেখক : বকুল খান।
সাধারণ সম্পাদক
অল ইউরোপিয়ান বাংলা প্রেসক্লাব ।