জার্মানি বাংলাদেশী রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের দ্রুত দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে

 কবির আহমেদ, ইউরোপ ডেস্কঃ জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন বাতিল হওয়া বাংলাদেশীদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু হয়েছে। জার্মানির সংবাদ সংস্থা ডয়েচে ভেলের (DW) ইনফোমাইগ্রেন্টস পোর্টাল জানিয়েছেন জার্মানি থেকে নেগেটিভ রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের দেশে পাঠানোর পুনরায় গতি পেয়েছে।

সংবাদ সংস্থার খবরে আরও বলা হয়েছে আগামী সপ্তাহে একসঙ্গে ৬২ বাংলাদেশীকে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে জার্মানির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সম্প্রতি প্রকাশিত হয় যে ‘আট শতাধিক বাংলাদেশীকে জার্মানি থেকে ঢাকায় ফেরত পাঠাচ্ছে জার্মান কর্তৃপক্ষ’৷ আর এই বিতাড়নে সহায়তা করছে বাংলাদেশ সরকার৷

সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ার পর জার্মানিতে বসবাসরত অনিয়মিত বাংলাদেশী অভিবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে৷ কার নাম বিতাড়নের তালিকায় আছে, কার নেই তা নিয়ে নানা স্থানে যোগাযোগ করতে দেখা গেছে তাদের৷ বিতাড়নের আতঙ্কে থাকাদের একজন আজিজ মোহাম্মদ ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানান যে দেশে ফেরত পাঠানো হলে তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে পারেন৷

জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রত্যাশি আজিজ বলেন, ‘‘আমি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় আমার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মামলা করা হয়েছে যাতে আমাকে কারাবন্দি করে রাখা যায়৷ আমি নিপীড়ন এড়াতে ২০১৪ সালে গ্রিস হয়ে জার্মানিতে পালিয়ে আসি।”

৩১ বছর বয়সি আজিজ মোহাম্মদ বর্তমানে জার্মানির ম্যুনস্টার শহরে অবস্থান করছেন৷ সেখানে গত কয়েকবছর ধরে কর প্রদান করে বৈধভাবে একটি বেকারিতে চাকুরি করছেন তিনি৷ তবে, জার্মানিতে তার আশ্রয়ের আবেদন বাতিল হয়ে গেছে৷আজিজ মোহাম্মদ আরও বলেন, ‘‘২০১৭ সালে জার্মান কর্তৃপক্ষ আমাকে জানায় যে আমার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন বাতিল হয়েছে৷ এরপর আমি আপিল করেছি, তবে তারা আর কোনো উত্তর দেয়নি৷’’

কারো আশ্রয়ের আবেদন চূড়ান্তভাবে বাতিল হলে জার্মানি সাধারণত হঠাৎ করে সেই ব্যক্তিকে ধরে বাংলাদেশের বিমানে তুলে দেয়৷ তখন সেই ব্যক্তিকে জার্মানিতে কারো সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ দেয়া হয় না৷ এরই মধ্যে কয়েকজন বাংলাদেশিকে এভাবে বিতাড়ন করা হয়েছে৷ ফলে আজিজ মোহাম্মদের মতো আরো অনেকে এখন বিতাড়নের আতঙ্কে ভুগছেন৷

বার্লিনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া অনিয়মিত বাংলাদেশী অভিবাসীদের দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন৷ তবে, তিনি জানিয়েছেন যে ঢাকার গণমাধ্যমে আটশ’র বেশি বাংলাদেশীকে ফেরত পাঠানোর যে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে তা পুরোপুরি সঠিক নয়৷

তিনি ডয়েচে ভেলের  ইনফোমাইগ্রেন্টসকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) বসবাসের অনুমতি নেই এমন বাংলাদেশীদের দেশে ফেরত পাঠাতে সহায়তা করতে বাংলাদেশ ও ইইউ এর মধ্যে ২০১৭ সালে ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরস (এসওপি)’ স্বাক্ষরিত হয়৷ আমরা সেই চুক্তি অনুসরণ না করলে আমাদের উপর ভিসা কড়াকড়ি আরোপ করতে পারে ইইউ৷’’

২০১৭ সাল থেকে এখন অবধি ৮১৬ জনের জন্য ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ ইস্যু করতে বাংলাদেশের প্রতি জার্মানি অনুরোধ জানিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন রাষ্ট্রদূত৷ তবে, তিনি বলেন, ‘‘এদের মধ্যে অনেকে ইতিমধ্যেই জার্মানি ছেড়ে চলে গেছেন৷ ফলে জার্মানি এখন আটশ’র বেশি বাংলাদেশীকে ফেরত পাঠাচ্ছে এটা বলা ঠিক নয়৷ বর্তমানের সংখ্যাটি অনেক কম৷’’

আগামী ২৬ অক্টোবর ৬২ বাংলাদেশীকে একসঙ্গে ফেরত পাঠানো হবে বলেও জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত ভূঁইয়া৷ তিনি বলেন, ‘‘তাদের ঢাকা পৌঁছে দিতে ১৩০ জনের মতো জার্মানির নিরাপত্তারক্ষীও বাংলাদেশের ভিসা নিয়েছেন৷’’

করোনা মহামারির কারণে বেশ কিছুদিন অনিয়মিত অভিবাসীদের বিতাড়ন সীমিত থাকলেও এখন তা পুনরায় গতি পেয়েছে বলেও জানিয়েছেন বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত৷ ‘‘এবারই প্রথম একসঙ্গে ৬২ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানোর ঘটনা ঘটছে,’’ বলেন তিনি৷

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণকারীরা বলছেন বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা তেমন একটা দেখা যায়নি৷ আফগানিস্তান বা সিরিয়ার মতো পরিস্থিতিও দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে নাই৷ তাই, ইইউতে দেশটির বাসিন্দাদের আশ্রয়ের আবেদন তেমন একটা গ্রহণ করা হয় না৷

মোটের উপর ইউরোপীয় কমিশন সম্প্রতি বাংলাদেশ, ইরাক এবং গাম্বিয়ার নাগরিকদের ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপের সুপারিশ করেছে, যদি তারা ইউরোপে অবস্থানরত বৈধ বসবাসের অধিকার নেই এমন দেশগুলোর নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে সহায়তা না করে৷

বাংলাদেশ সরকার এরকম নিষেধাজ্ঞা এড়াতে দূতাবাসগুলোর প্রতি স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সহায়তার নির্দেশনা দিয়েছে৷ যদিও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবস্থাদৃষ্টে শান্ত রয়েছে, তা সত্ত্বেও দেশটির মানবাধিকার এবং বাকস্বাধীনতা পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি ঘটছে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং কমিটি এগেনিস্ট টর্চারের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো মাঝে মাঝেই বাংলাদেশের সরকারের বিরুদ্ধে নির্বিচারে আটক, নির্যাতন, গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনে৷  

গত দশকে দেশটিতে বেশ কয়েকজন ইসলাম ধর্মের সমালোচক ব্লগার ও সমকামীদের অধিকারের পক্ষে সংগ্রামরত অ্যাক্টিভিস্টকে হত্যা করেছে উগ্রপন্থিরা৷ এরপর অনেক বাংলাদেশি ব্লগার ও অ্যাক্টিভিস্ট ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেন৷  অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জার্মানির বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ বের্নহার্ড হার্টলাইন মনে করেন, জার্মানি থেকে অনিয়মিত অভিবাসীদের বিতাড়ন একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া এবং বাংলাদেশও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়৷ তবে তিনি বাংলাদেশীদের আশ্রয়ের আবেদনগুলো আলাদা আলাদাভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাইয়ের আহ্বান জানান৷ 

তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়মিতই দেখা যাচ্ছে৷ কিছুদিন আগে কারাগারে একজন লেখকের রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে৷ মৃত্যুর আগে তার জামিনের আবেদন বেশ কয়েকবার বাতিল হয়েছিল৷ তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচক হিসেবে পরিচিত ছিলেন৷’’

‘‘এধরনের ঘটনা এটাই ইঙ্গিত দেয় যে দেশটিতে শুধু নাস্তিক ব্লগার বা এলজিবিটিকিউ অ্যাক্টিভিস্টরাই নয়, সরকার সমালোচক এবং বিরোধী দলের নেতাকর্মীরাও হুমকি এবং নির্যাতনের মুখে রয়েছেন।”

এদিকে, পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েকবছরে জার্মানিতে বাংলাদেশিদের আশ্রয়ের আবেদনের হার কমতে শুরু করেছে৷ জার্মানির কেন্দ্রীয় অভিবাসন এবং শরণার্থী দপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সাল অর্থাৎ এসওপি চুক্তি স্বাক্ষরের বছরে জার্মানিতে আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন ৫৭১ বাংলাদেশী৷ ২০২০ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৮৯ জনে৷

চলতি বছর সেপ্টেম্বরের শেষ অবধি ৮৮ বাংলাদেশি জার্মানিতে আশ্রয়ের আবদেন করেছেন৷ আর সামগ্রিকভাবে এধরনের আবেদন মঞ্জুরের হার ৬.১%, জানাচ্ছে পরিসংখ্যান৷

কেন্দ্রীয় অভিবাসন এবং শরণার্থী দপ্তরের প্রেস স্টাফ ক্রিস্টিনা বানাশ এই বিষয়ে ডয়েচে ভেলের ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানান যে আশ্রয়ের আবেদন পরীক্ষার ক্ষেত্রে তার দপ্তর বিভিন্ন সূত্র থেকে সংশ্লিষ্ট দেশের পরিস্থিতি যাচাই করে৷ তিনি বলেন, ‘‘এই প্রক্রিয়া এটাই নিশ্চিত করে যে একজন আশ্রয়প্রার্থীর আবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া ব্যক্তিরা প্রার্থীর দেশ এবং সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত৷’’

 14,625 total views,  1 views today