আগামী দিন ২৬ অক্টোবর অস্ট্রিয়ার জাতীয় দিবস

১৯৬৫ সাল থেকে প্রতি বছর ২৬ অক্টোবর অস্ট্রিয়ার জাতীয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবস হিসাবে এবং ১৯৬৭ সাল থেকে এই দিনটি সরকারি ছুটির দিন হিসাবে পালিত হয়ে আসছে
কবির আহমেদ, ইউরোপ ডেস্কঃ বৈশ্বিক মহামারী করোনার জন্য গত বৎসের ন্যায় এই বৎসরও অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রপতি ভবন হোফবুর্গের হেলডেন স্কয়ারে ঐতিহ্যগত সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজ ও সমরাস্র প্রদর্শনী সর্ব সাধারণের জন্য প্রদর্শন বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।
অস্ট্রিয়ার সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে, দিনটি উপলক্ষে অস্ট্রিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে ভিয়েনার মাইনোরিটেনপ্ল্যাটজে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিজস্ব প্রোগ্রামের মাধ্যমে দিনটির কার্যক্রম শুরু হবে।
পরে অস্ট্রিয়ার Heldenplatz-এ নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের ঐতিহ্যগত শপথ গ্রহণের পাশাপাশি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভিয়েনার কেন্দ্রস্থলে একটি অন-সাইট প্রোগ্রাম প্রদর্শন করবে।
অস্ট্রিয়ার ফেডারেল প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ফান ডার বেলেন সৈনিকদের শপথ বাক্য পাঠ করাবেন। প্রতিবারের মত এবারও ১০০ শত নতুন সৈনিক শপথ নিবেন।
এই অনুষ্ঠানে অস্ট্রিয়ার সরকার প্রধান চ্যান্সেলর আলেকজান্ডার শ্যালেনবার্গ ও উপ প্রধান ভাইস চ্যান্সেলর ভার্নার কোগলার সহ মন্ত্রিসভার সদস্যগণ এবং জাতীয় সংসদের বিরোধীদলের প্রধানগণ উপস্থিত থাকবেন। করোনার জন্য স্বল্প পরিসরের এই অনুষ্ঠানে গত বছরের মতো এবারও কোন সাধারণ জনগণের উপস্থিতি বাতিল করা হয়েছে। অবশ্য অস্ট্রিয়ার রাস্ট্রায়ত্ব টেলিভিশন ORF অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করবে সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে জাতীয় দিবসের কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কার্ল নেহামার।

এখানে অস্ট্রিয়ান পুলিশের বিশেষ কমান্ডো ইউনিট WEGA, কোবরা বা আলপাইন পুলিশের মতো বিশেষ ইউনিটগুলিকে জানার জন্য এবং জয়েন্ট থেকে প্রতিরোধ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে নিরাপত্তার বিষয়ে ব্যাপক তথ্য উপস্থাপন করা হবে।
এছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানে আরও অংশগ্রহণ করবেন অস্ট্রিয়ার ফেডারেল ফায়ার ব্রিগেড অ্যাসোসিয়েশন, জল উদ্ধার, পুলিশের সমুদ্র ও বিদ্যুৎ পরিষেবা, আলপাইন পুলিশ, কোবরা টাস্ক ফোর্স, Gemeinschaft.Sicher এর দল সহ অস্ট্রিয়ান রেড ক্রস। গুহা উদ্ধার এবং পর্বত উদ্ধারের পাশাপাশি সেই “সেফ অস্ট্রিয়া বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ” ইত্যাদি ইউনিট সমূহ।
উল্লেখ্য যে,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) সময় অস্ট্রিয়া জার্মানির পক্ষ নিয়েছিল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ৪ মিত্র শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গ্রেটব্রিটেন এবং ফ্রান্স অস্ট্রিয়া দখল করে নেয়। মিত্র শক্তি অস্ট্রিয়াকে চার ভাগে ভাগ করে নেন। রাজধানী ভিয়েনাকেও চার ভাগে ভাগ করে মিত্র শক্তি নিজেদের দখলে রেখেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে অস্ট্রিয়ার প্রায় এক লাখ সৈনিক নাৎসী বাহিনী হিসাবে রাশিয়া অভিযানে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই একলাখ সৈনিক থেকে মাত্র এক হাজার সৈনিক জীবিত ফেরত আসতে পেরেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন মিত্র শক্তি বা বাহিনী আকাশ পথে অস্ট্রিয়ার উপর বিশেষ করে রাজধানী ভিয়েনায় প্রচন্ড বোমাবর্ষণ করে সম্পূর্ণ স্থাপত্য ধ্বংস করে ফেলে। বলা হয় সে সময় ভিয়েনায় আর কোন উঁচু ভবন অক্ষত অবস্থায় ছিল না। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মিত্র শক্তির এক তথ্য অনুসারে ভিয়েনায় বিমান থেকে ফেলা ফ্লাইং বোমার মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বোমা এখনও অক্ষত অবস্থায় ভিয়েনার মাটির নীচে বা নদীতে আছে। এজন্য ভিয়েনায় বিভিন্ন নির্মাণ কাজের জন্য মাটি খোড়ার সময় বেশ সতর্কতা অবলম্বন করা হয় এবং যুদ্ধের এতো দীর্ঘ বৎসর পরেও এখন প্রায়ই সময় এই সমস্ত ফ্লাইয়িং বোমা পাওয়া যাচ্ছে।
চার মিত্র দেশের সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত “মিত্র নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল” দীর্ঘ ১০ বৎসর (১৯৪৫-১৯৫৫) যাবৎ অস্ট্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ তাদের কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন। যদিও অস্ট্রিয়ান সংসদ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ছিল,তবে আইন সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ বা সরকারের আইনানুগ ব্যবস্থা মিত্র নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলের হাতে ন্যস্ত ছিল। কোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে মিত্র নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলের সম্মতির প্রয়োজন হত। তারা যদি কোন ভেটো বা অনুমোদন না দিতেন তখন সেটি বাতিল হয়ে যেতো।
মিত্র শক্তির দখলের অবসান ঘটাতে এবং অস্ট্রিয়াকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতির চুক্তির বিষয়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার পর ভিয়েনায় সাবেক রাজার বেলভেদার প্রাসাদে ১৯৫৫ সালের ১৫ মে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং ২৭ জুলাই ১৯৫৫ সাল থেকে চুক্তিটি কার্যকর হয়েছিল। তারপর মিত্র বাহিনী অস্ট্রিয়া থাকলেও রাস্ট্রীয় ক্ষমতা অস্ট্রিয়ানদের কাছেই ছিল। মিত্র বাহিনী ১০ বৎসর যাবৎ তাদের সেনাবাহিনীকে অস্ট্রিয়া থেকে সরিয়ে নেয়। শেষ রাশিয়ান সৈন্য ১৯৬৫ সালে অস্ট্রিয়া ত্যাগ করলে তখন দেশটি সম্পূর্ণ বিদেশী সৈন্য মুক্ত হয়।
১৯৫৫ সালের ২৬ অক্টোবর অস্ট্রিয়ান সংসদ স্থায়ী নিরপেক্ষতা সংক্রান্ত সাংবিধানিক আইন পাস করেন। ১৯৯৫ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (EU) প্রবেশের পূর্বে অস্ট্রিয়া বিশ্বে একটি নিরপেক্ষ দেশ হিসাবে বেশ সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। এই নিরপেক্ষতার ফলেই অস্ট্রিয়ায় জাতিসংঘের আণবিক শক্তি কমিশনের সদর দফতর, তেল উত্তোলনকারী দেশ সমূহের সংস্থা OPEC এর সদর দফতর সহ আরও অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার অফিস অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা রয়েছে। তবে অস্ট্রিয়া ইইউ সদস্য দেশ হলেও সে তার নিরপেক্ষ নীতি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।
১৯৫৫ সালের চুক্তি স্বাক্ষরের ১০ বৎসর পর ১৯৬৫ সালের ২৬ অক্টোবর থেকে অস্ট্রিয়ায় নিয়মিতভাবে এই দিনটিকে দেশের জাতীয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পালন করে আসছে।
14,706 total views, 1 views today