বৈশ্বিক মহামারীর চ্যালেঞ্জের মধ্যে অভিবাসন প্রত্যাশীদের নিয়ে ইউরোপে অসন্তুষ্টি

অস্ট্রিয়া সহ সমগ্র ইউরোপে করোনার নতুন সংক্রমণের বিস্তার লাভের মধ্যেই নতুন অবৈধ অভিবাসন প্রত্যাশীদের আগমনে অস্বস্তিতে ইইউ।

 কবির আহমেদ, ইউরোপ ডেস্কঃ বৈশ্বিক মহামারীর শুরুতে কমে এসেছিল ইউরোপে অবৈধ অভিবাসন প্রত্যাশী কিন্তু ইউরোপ আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতেশুরু করলে অভিবাসনের স্রোতে জোয়ার আসতে শুরু করে।এরই মধ্যে ইউরোপের প্রায় সব দেশেই করোনার নতুন সংক্রমণ বৃদ্ধির মধ্যে নতুন অভিবাসন প্রত্যাশীদের আগমনে পুনরায় ইইউ সহ বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

ইউরোপের অভিবাসীদের সম্পর্কিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইনফোমাইগ্রেন্টস জানিয়েছে অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে ইউরোপের অনেক দেশেই বর্তমান করোনা মহামারীর নতুন প্রাদুর্ভাবের মধ্যে এই অবৈধ অভিবাসন প্রত্যাশীদের নিয়ে এক অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ইইউর বিভিন্ন দেশ সবেমাত্র করোনা পরবর্তী নিজেদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে নানানমুখী পরিকল্পনা করছে।

ফলে ইউরোপমুখী অভিবাসনে।ততটা স্বস্তির পরিস্থিতি নেই,যেমনটা ছিল সেই ২০২০ সালে। এই বৎসর অভিবাসন প্রত্যাশীরা নষ্ট হওয়া সময়কে ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। বিপদের ঝুঁকি সম্বন্ধে অবগত থাকলেও দলে দলে মানুষ পাড়ি দিচ্ছেন ইউরোপের উদ্দেশ্যে।

২০২০ সালে ৩৩ শতাংশ কমে আসে আগের তুলনায় ইউরোপে আশ্রয়ের আবেদনের হার, জানাচ্ছে ইউরোপিয়ান কমিশনের একটি প্রতিবেদন। এত বড় হ্রাস ২০১৩ সালের পর আর দেখা যায়নি বলে জানায় সেই প্রতিবেদনটি। শুধু তাই নয়, করোনা অতিমারির ফলে বেশ কিছু পরিষেবায় ভাটা পড়ে, যা এতদিন আশ্রয়প্রার্থীদের আগমনের সময় তাদের সাহায্য করত। পাশাপাশি, পরিচিত পথগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নতুন নতুন রুট ও পন্থা অবলম্বন করে অবৈধ অভিবাসনের সাথে যুক্তরা।

গ্রিসে সীমান্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অভিবাসনের মোড় ঘুরে যায় পূর্ব ভূমধ্যসাগরের দিকে ও বিপজ্জনক মধ্য ভূমধ্যসাগরের পথে। ইইউ সীমান্ত সংস্থা ফ্রন্টেক্সের মতে, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৬৪ শতাংশ বেড়েছে অনিয়মিত অভিবাসন। বিশেষ করে তুরস্ক থেকে আলবেনিয়া, সার্বিয়া, উত্তর ম্যাসিডোনিয়া ও বসনিয়ার এই বলকান পথে বেড়েছে ভিড়। তারা আরও জানান,মধ্য ভূমধ্যসাগরের পথে যাত্রার হার বেড়ে।হয়েছে দ্বিগুণ।

এই বছর মধ্য ভূমধ্যসাগরের প্রাণঘাতী পথে সবচেয়ে বেশি এসেছেন তিউনিশিয়ার নাগরিকরা। এরপর দ্বিতীয় স্থানেই রয়েছে বাংলাদেশ, তৃতীয় স্থানে মিশর। এদের বেশিরভাগই ইউরোপের উদ্দেশ্যে তাদের যাত্রা শুরু করেন লিবিয়া বা তিউউনিশিয়ার উপকূল থেকে। এর ফলে সাগরে ইউরোপের অভিবাসীদের মৃত্যু বেড়েছে দ্বিগুণ।

ইউরোপ,অভিবাসন ও অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম-এর ডাটা বিশেষজ্ঞের মতে,”ইউরোপসহ গোটা বিশ্বে কর্মক্ষম জনতার একটা বড় অংশই অভিবাসী”। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রায় ১৩ শতাংশ কর্মীই অভিবাসী। কিন্তু কর্মক্ষম অভিবাসীরা বিদেশে কাজ করলেও স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে তাদের অন্তর্ভুক্তি অসমান।

ডাটা বিশেষজ্ঞ আরও জানান,আইওএম-এর তথ্যমতে বিশ্বের ১৫২টি দেশের মাত্র ৩৩ শতাংশ রাষ্ট্রেই অনিয়মিত অভিবাসীদের করোনা টিকা দেবার জাতীয় নীতি রয়েছে।তারপরেও,করোনা মহামারীর  সময় শ্রমের অভাব পূরণ করতে ইইউ-কে নির্ভর করতে হয়েছে বাইরে থেকে আসা মৌসুমী কর্মীদের উপর।

একদিকে সংক্রমণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঝুঁকিতে থাকা অভিবাসীরা, অন্যদিকে অর্থনীতিতে তাদের প্রয়োজন ও সাদর অংশগ্রহণ, এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য ইউরোপের সামনে চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি, উত্তর আফ্রিকা থেকে ইউরোপমুখী অভিবাসনকে নিয়ন্ত্রিত করা গেলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করেন আইওএম-এর আরেক কর্মী জুলিয়া ব্ল্যাক।

তিউনিশিয়ার মতো বেশ কিছু দেশে করোনা মহামারীর জন্য অর্থনৈতিক ধস নেমে এসেছে। ফলে, অনেকেই কাজ হারিয়ে পাড়ি দিচ্ছেন ইউরোপের দিকে। করোনা যে শুধু ইউরোপের জন্য অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে নতুন বাঁধা সৃষ্টি করছে তা নয়। সাথে, মানুষকে ঘরবাড়ি ছেড়ে বিপজ্জনক রুটে দেশান্তরী হতেও বাধ্য করছে অনেক ক্ষেত্রে, এমনটাই জানিয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর মাইগ্রেশন পলিসি ডেভেলপমেন্টের বলিষ্ঠ কর্মী মার্টিন হফমান।

ইউরোপের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম এবিষয়ে একমত হয়ে বলেছে যে, “সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, যার সাথে এসে মিলেছে করোনা মহামারী, মানুষের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করছে। এর ফলে, ইউরোপের দিকে আসা অনিয়মিত অবৈধ অভিবাসনের ঢেউ আরও বাড়তে পারে।”

আগামীকাল সোমবার ৮ নভেম্বর থেকে অস্ট্রিয়ায় করোনার চতুর্থ প্রাদুর্ভাবে সংক্রমণের বিস্তার হ্রাসে ২-জি নিয়ম কার্যকর হতে যাচ্ছে। এদিকে আজ অস্ট্রিয়ায় নতুন করে করোনায় সংক্রমিত শনাক্ত হয়েছেন ৮,৫৫৪ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ২০ জন। রাজধানী ভিয়েনায় আজ নতুন করে সংক্রমিত শনাক্ত হয়েছেন ১,১৫০ জন।

অস্ট্রিয়ার অন্যান্য ফেডারেল রাজ্যের মধ্যে OÖ রাজ্যে ২,২১১ জন, NÖ রাজ্যে ২,১০৫ জন, Salzburg রাজ্যে ৮৬৭ জন,Tirol রাজ্যে ৬৭৪ জন, Kärnten রাজ্যে ৬০৮ জন, Steiermark রাজ্যে ৪১৯ জন, Vorarlberg রাজ্যে ৩৬৭ জন এবং Burgenland রাজ্যে ১৫৩ জন নতুন করে করোনায় সংক্রমিত শনাক্ত হয়েছেন।

অস্ট্রিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী আজ সমগ্র অস্ট্রিয়াতে করোনার প্রতিষেধক টিকা দেয়া হয়েছে ১৩,৪৯৭ ডোজ এবং এই পর্যন্ত মোট দেয়া হয়েছে ১,১২,৬৯,৩৬৮ ডোজ। অস্ট্রিয়ায় এই পর্যন্ত করোনার প্রতিষেধক টিকার সম্পূর্ণ ডোজ গ্রহণ করেছেন মোট ৫৭ লাখ ৬৩ হাজার ২৮৬ জন,যা দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬৪,৫ শতাংশ।

অস্ট্রিয়ায় এই পর্যন্ত করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৮,৮৩,৮৮৭ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ১১,৫০২ জন।করোনার থেকে এই পর্যন্ত আরোগ্য লাভ করেছেন ৭,৯৯,৮৩৯ জন। বর্তমানে অস্ট্রিয়ায় করোনার সক্রিয় রোগীর সংখ্যা ৭২,৫৪৬ জন। এর মধ্যে আইসিইউতে আছেন ৩৬৫ জন এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ১,৯০৩ জন। বাকীরা নিজ নিজ বাড়িতে আইসোলেশনে আছেন।

 14,715 total views,  1 views today