ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধের আশঙ্কা

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট ন্যাটো(NATO) পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ বিমান ও যুদ্ধ জাহাজ সমবেত করছে। যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ইউরোপে ৫,০০০ হাজার সেনা পাঠাচ্ছে।
কবির আহমেদ, ইউরোপ ডেস্কঃ পূর্ব ইউরোপের দেশ ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে আবারও বিশ্বযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে বিশ্ব। ঘটনার সূত্রপাত রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সদস্য দেশ ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের সামরিক জোট ন্যাটো(NATO) তে যোগদান করার প্রক্রিয়া শুরু করার পর থেকেই। যদিও ইউক্রেন এখনও সম্পূর্ণ সদস্য পদ লাভ করে নি। উল্লেখ্য যে,১৯৯১ সালে রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ফেডারেশন ভেঙ্গে গেলে ইউক্রেন সহ পনেরটি দেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
ন্যাটো হচ্ছে উত্তর আটলান্টিক দেশ সমূহের সামরিক নিরাপত্তা জোট। ইংরেজিতে North Atlantic Treaty Organisation,যাকে সংক্ষেপে NATO বলা হয়ে থাকে। ১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল মাসে এই জোট প্রতিষ্ঠিত হয়। ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোর পারস্পরিক সামরিক সহযোগিতা প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ।
ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলো আটলান্টিক মহাসাগরের দুই পাড়ে অবস্থিত উত্তর আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা এবং ইউরোপের অধিকাংশ দেশ এই জোটের সদস্য। এছাড়া তুরস্কও এই জোটের সদস্য। ন্যাটোর বর্তমান সদর দপ্তর বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে। পূর্বে এর সদর দপ্তর ছিলো ফ্রান্সের প্যারিসে। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে তুরস্ক ও আলবেনিয়াই কেবল মুসলিম দেশ।
মস্কো কেন্দ্রিক রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ঐক্যতন্ত্র, সংক্ষেপে সোভিয়েত ঐক্যতন্ত্র বা সোভিয়েত ইউনিয়ন, ছিল একটি একদলীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় সমাজতান্ত্রিক দেশ, যার অস্তিত্ব ছিল ১৯২২ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে ১৫টি নতুন প্রজাতন্ত্র বা নতুন দেশ সৃষ্টি হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গার পর নবগঠিত দেশ সমূহ যথাক্রমে রাশিয়া, লিথুনিয়া, জর্জিয়া, ইউক্রেন, মলদোভা, বেলারুশ, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কাজাখাস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান,কিরগিজিস্তান, তাজিকিস্তান,এস্তোনিয়া ও লাটভিয়া।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে নবগঠিত স্বাধীন রাষ্ট্র সমূহ রাশিয়ার সাথেই অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক দিক দিয়ে সংযুক্ত ছিল। তবে ইউক্রেন ধীরে ধীরে রাশিয়ার বিপরীতে পশ্চিমা বিশ্বের দিকে জুকে পড়ে। ফলে তখন থেকেই রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি রাশিয়া ইউক্রেন সীমান্তে এক লাখ সৈন্য জড়ো করলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। অবশ্য রাশিয়া বলছে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য সে এই বিশাল সৈন্য বাহিনীর ইউক্রেন সীমান্তে সমাবেশ ঘটিয়েছে।
ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার এক লাখ সৈন্য সমাবেশ যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন দখলের ঈন্গিত হিসাবেই দেখছেন। সঙ্কট নিরসনে ইতিমধ্যেই রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেরগে লাভরবের সাথে জার্মানির চ্যান্সেলর শোলজৎ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালিনা বায়েরবকের আলোচনায় কোন সফলতা আসে নি।
তাছাড়াও গত সপ্তাহে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী(সেক্রেটারী অব স্টেট) ব্লিনকেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেরগে লাভরবের সাথে বৈঠক করেছেন। তবে কোন সফলতা ছাড়াই তাদের বৈঠক শেষ হয়। এই সপ্তাহের শেষে তাদের আবারও বৈঠকে বসার কথা রয়েছে।
এদিকে ইউকে থেকে সম্প্রচারিত জনপ্রিয় বাংলা টেলিভিশন ION TV জানিয়েছেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন রাশিয়ার প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন,ইউক্রেনে হামলা হলে তা হবে এক বিপর্যয়। অন্যদিকে বিবিসি জানিয়েছে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার আশঙ্কায় ন্যাটো সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে এবং ইউক্রেন দূতাবাস থেকে কর্মী সরানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র।
বিবিসি আরও জানায়,ন্যাটো জোট ঘোষণা করেছে ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার অব্যাহত সামরিক উপস্থিতির প্রতিক্রিয়ায় পূর্ব ইউরোপে জোটের সদস্য দেশগুলোতে বাড়তি যুদ্ধ জাহাজ এবং যুদ্ধ বিমান পাঠানো হচ্ছে। নেটো বলছে তাদের সৈন্যদের প্রস্তুত রাখা হচ্ছে।
এদিকে, ব্রিটেন ইউক্রেনে তাদের দূতাবাস থেকে কিছু কর্মী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রত্যাহার করছে। ব্রিটিশ সরকার বলছে রাশিয়ার সামরিক হুমকির মুখে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর জানাচ্ছে ইউক্রেনে ব্রিটিশ কূটনীতিকদের জন্য কোন সুনির্দিষ্ট ঝুঁকি তৈরি না হলেও তারা কিয়েভে তাদের দূতাবাসের অর্ধেক কর্মীকে ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করেছে। তবে ব্রিটেন কিয়েভে তাদের দূতাবাস খোলা রাখছে।
এর আগে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন থেকে তাদের দূতাবাস কর্মীদের পরিবারের সদস্যদের দেশে চলে আসার নির্দেশ দেয়। ইউক্রেনে আমেরিকান কোম্পানির সরাসরি নিযুক্ত কর্মীদেরও স্বেচ্ছায় দেশত্যাগের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আমেরিকা বলছে আক্রমণ “যে কোন মুহূর্তে” ঘটতে পারে। আমেরিকা তার নাগরিকদের এখন ইউক্রেন বা রাশিয়ায় ভ্রমণ না করার পরামর্শ দিয়েছে। রাশিয়া কোনরকম সামরিক পদক্ষেপের পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করেছে, যদিও সীমান্তে রুশ সৈন্য সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য বলছে এখনই এধরনের প্রত্যাহার অযৌক্তিক। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে তারা ইউক্রেন থেকে তাদের দূতাবাস কর্মী বা তাদের পরিবারের সদস্যদের এখনই প্রত্যাহার করছে না। তবে, জার্মানি বলেছে তাদের কূটনীতিকদের পরিবারের সদস্যরা চাইলে ইউক্রেন ছাড়তে পারে।
ইইউর পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা এ বিষয় নিয়ে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন যে বৈঠকে ভিডিও কলের মাধ্যমে যোগ দেবেন আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো আরো বলছে, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হবে। তারা বাড়তি সৈন্য প্রস্তত রাখছে এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও শক্তিশালী করছে। ডেনমার্ক, স্পেন, বুলগেরিয়া এবং নেদারল্যান্ডসসহ নেটোর সদস্য দেশগুলো প্রতিরক্ষা জোরদার করতে পূর্ব ইউরোপে আরও জঙ্গি বিমান এবং রণতরী পাঠাচ্ছে।
14,968 total views, 1 views today